পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এলসি জুনে, আমদানিতে স্থবিরতা

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য নেই। আর মানুষের ভোগব্যয়ও আগের তুলনায় কমে গেছে। এই তিনটি প্রধান কারণে চলতি বছরের জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, কভিড মহামারির সময়কেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের পতন, যা আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক ইঙ্গিত বহন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে মোট ৪.১৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের জুনের তুলনায় প্রায় ২৪.৪২ শতাংশ কম। ২০২৩ সালের জুনে খোলা হয়েছিল ৫.৪৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি। এমন নিম্নমাত্রার এলসি খোলা এর আগে হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে, কভিড সংকটের সময়, তখন এলসি খোলা হয়েছিল ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের।
এবারের কমতির প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের ধীরগতি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমদানিকারকদের একটি বড় অংশ আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, কারণ বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তাঁর মতে, আমদানি কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যাংকগুলোর আয়ও প্রভাবিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট ৬৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ০.১৮ শতাংশ বেশি।
তবে সব খাতে আমদানি বাড়েনি। বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে। একইভাবে কমেছে পেট্রোলিয়াম, শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি। এই প্রবণতা অর্থনীতিতে স্থবিরতা ও মন্দার লক্ষণ বহন করে।
জুনে এলসি নিষ্পত্তির চিত্রটিও একই রকম।
ওই মাসে ৪.৫৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা গত বছরের জুনের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম। এটি গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বশেষ এত কম নিষ্পত্তি হয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট এলসি নিষ্পত্তি ৬৯.৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.১৮ শতাংশ বেশি।
এলসি কমার ফলে বাজারে ডলারের চাহিদাও কমে যায়। এতে ডলারের দাম কমতে শুরু করে। জুনের শেষে ও জুলাইয়ের শুরুতে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দর প্রায় তিন টাকা কমে ১২০ টাকায় নেমে আসে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩ জুলাই ইতিহাসে প্রথমবার নিলামের মাধ্যমে বাজার থেকে ডলার কিনে হস্তক্ষেপ করে। ওই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২১.৫০ টাকা দরে ১৭৩ মিলিয়ন ডলার কেনে। পরে আরো দুটি নিলামে যথাক্রমে ৩৭৩ মিলিয়ন ও ১০ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে ডলারের দরপতন বন্ধ হয় এবং দাম আবার বাড়তে শুরু করে। ২৭ জুলাই রেমিট্যান্স ও আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলারের দাম ছিল ১২২.৫০ থেকে ১২২.৮৩ টাকা।
আরেক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জানান, দেশে বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। ফলে নতুন করে মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য আমদানির প্রয়োজনও তেমন নেই। এখন যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে, তার বড় অংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, যেগুলোর আমদানি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থেকেই যায়।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, আমদানি এভাবে কমে যাওয়া দীর্ঘ মেয়াদে শিল্প ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে এখনই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং আমদানির প্রবাহ স্বাভাবিক করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।